রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৩৮ পূর্বাহ্ন
                                           

বিশেষ সাক্ষাৎকার: হেনরি কিসিঞ্জার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবসম্মত নয়

গত ২৯ নভেম্বর প্রয়াত হয়েছেন হেনরি কিসিঞ্জার। তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে। মৃত্যুর আগে ১৮ অক্টোবর তিনি ওয়ার্ল্ড ডট মাইন্ডস নামে অলাভজনক একটি ফাউন্ডেশনে এক ভার্চ্যুয়াল আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন। এতে আরও ২৫ বিশিষ্ট ব্যক্তি যুক্ত হন। তাঁরা কিসিঞ্জারকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তাঁর এই সাক্ষাৎকার ২ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম পলিটিকোতে প্রকাশ করা হয়। এ আয়োজনে কিসিঞ্জারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল ওয়ার্ল্ড ডট মাইন্ডসের প্রতিষ্ঠাতা সুইস উদ্যোক্তা ও দ্য আর্ট অব থিঙ্কিং ক্লিয়ারলি বইয়ের লেখক রল্‌ফ ডোবেলির। রল্‌ফ ডোবেলি বলেন, কিসিঞ্জারের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি ভাবতেই পারেননি, এটিই হতে পারে কিসিঞ্জারের শেষ সাক্ষাৎকারগুলোর একটি বা সম্ভবত তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার।

প্রশ্ন: বোঝাই যাচ্ছে, হামাসের বিরুদ্ধে পূর্ণশক্তি খাটিয়ে জবাব দিচ্ছে ইসরায়েল। আপনি যদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জায়গায় থাকতেন, তাহলে কি ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতেন?

কিসিঞ্জার: দেখুন, আমি নেতানিয়াহুর জায়গায় নেই। তাই তাঁর ওপর অভিঘাত হিসেবে কাজ করবে, এমন সব শক্তির বিচার আমি করতে পারি না। আমি শান্তিপূর্ণ ফলের পক্ষে। হামাসের সঙ্গে সংঘাতে কোনো শান্তিপূর্ণ ফল আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনার পক্ষে। বিশেষ করে এ ঘটনার (সর্বশেষ সংঘাত) পর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সরাসরি আলোচনা খুব ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি না।

প্রশ্ন: মধ্যপ্রাচ্যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ছাড়া কি কখনো স্থায়ী শান্তি আসতে পারে?

কিসিঞ্জার: আনুষ্ঠানিক শান্তি কোনো স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। হামাস নিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখা যাচ্ছে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিষয়টি জটিল। একটি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সম্ভাবনা পরীক্ষার জন্য সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন গাজাকে আধা স্বাধীন করেছিলেন। এটি বাস্তবে পরিস্থিতিকে আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে। ২০০৫ সালে অবস্থা যেমনটা ছিল, সেই তুলনায় গত দুই বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সুতরাং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এ নিশ্চয়তা দেয় না যে আমরা গত সপ্তাহগুলোতে যা দেখেছি, তা আবার ঘটবে না।

ফলো করুন
হেনরি কিসিঞ্জার
হেনরি কিসিঞ্জারছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি
প্রশ্ন: বোঝাই যাচ্ছে, হামাসের বিরুদ্ধে পূর্ণশক্তি খাটিয়ে জবাব দিচ্ছে ইসরায়েল। আপনি যদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জায়গায় থাকতেন, তাহলে কি ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতেন?

কিসিঞ্জার: দেখুন, আমি নেতানিয়াহুর জায়গায় নেই। তাই তাঁর ওপর অভিঘাত হিসেবে কাজ করবে, এমন সব শক্তির বিচার আমি করতে পারি না। আমি শান্তিপূর্ণ ফলের পক্ষে। হামাসের সঙ্গে সংঘাতে কোনো শান্তিপূর্ণ ফল আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি আরব বিশ্ব ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনার পক্ষে। বিশেষ করে এ ঘটনার (সর্বশেষ সংঘাত) পর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সরাসরি আলোচনা খুব ফলপ্রসূ হবে বলে আমি মনে করি না।

প্রশ্ন: মধ্যপ্রাচ্যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান ছাড়া কি কখনো স্থায়ী শান্তি আসতে পারে?

কিসিঞ্জার: আনুষ্ঠানিক শান্তি কোনো স্থায়ী শান্তির নিশ্চয়তা দেয় না। হামাস নিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে দেখা যাচ্ছে, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিষয়টি জটিল। একটি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সম্ভাবনা পরীক্ষার জন্য সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন গাজাকে আধা স্বাধীন করেছিলেন। এটি বাস্তবে পরিস্থিতিকে আরও জটিল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে। ২০০৫ সালে অবস্থা যেমনটা ছিল, সেই তুলনায় গত দুই বছরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। সুতরাং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এ নিশ্চয়তা দেয় না যে আমরা গত সপ্তাহগুলোতে যা দেখেছি, তা আবার ঘটবে না।

প্রশ্ন: একমুহূর্তের জন্য কল্পনা করুন, আপনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন এবং আমরা এই সময় থেকে কয়েক মাস সামনে এগিয়ে আছি। আশা করা যায়, তখন হামাসের হাত থেকে ইসরায়েল রেহাই পেয়েছে। তারপর আমরা কী করব? গাজার কী হবে? ইসরায়েল সেই বিশ্বে কীভাবে নিরাপদ বোধ করবে? এ ধরনের একটি ফলের লক্ষ্যে আপনি কীভাবে আপসরফা করবেন?

কিসিঞ্জার: আমি বিশ্বাস করি, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের লক্ষ্যে না থেকে বরং পশ্চিম তীরকে জর্ডানের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া উচিত। এতে ইসরায়েলকে উৎখাত করতে সংকল্পবদ্ধ একটি অঞ্চল চলে গেল। মিসর আরবদের কাছাকাছি চলে গেছে। তাই ইসরায়েলের সামনে এগিয়ে যাওয়াটা খুব কঠিন হবে। আমি আশা করি, এসবের শেষে একটি আলোচনা হবে। কারণ, আমি আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের (ইয়ম কিপুর যুদ্ধ) শেষে আলোচনা করার সুযোগ পেয়েছিলাম। সে সময় আশপাশের শক্তির তুলনায় ইসরায়েল বেশ শক্তিশালী ছিল। বর্তমানে অব্যাহত সংঘাত প্রতিরোধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।

ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ধ্বংসস্তূপ ফিলিস্তিনের গাজা। গতকাল রাফাহ এলাকায়
ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ধ্বংসস্তূপ ফিলিস্তিনের গাজা। গতকাল রাফাহ এলাকায়ছবি: রয়টার্স
প্রশ্ন: যুক্তরাষ্ট্র কি ইসরায়েলের প্রতি সুদৃঢ় সমর্থন দেখাতে আগ্রহী হবে?

কিসিঞ্জার: এটাই করতে হবে।

প্রশ্ন: আমার কাছে মনে হচ্ছে, জো বাইডেন প্রশাসন ইরানকে যথেষ্ট স্পষ্ট এই বার্তা দিচ্ছে না যে হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে ইসরায়েলে হামলা চালালে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থা নেবে। এর পরিবর্তে যে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, তা অনেকটা ইরানকে খুশি করার জন্য বলে মনে হয়। এই হামলায় (হামাসের) ইরান সরাসরি জড়িত নয়, এমন একটা ভান করা হচ্ছে। আপনি যদি আজ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতেন, তাহলে কি ইরানকে ভিন্ন বার্তা দিতেন?

কিসিঞ্জার: আমি মনে করি, তারা চাইলে এটা করতে পারে। ইসরায়েলের উত্তর সীমান্তে হিজবুল্লাহর হাতে কয়েক হাজার ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এটি বিপজ্জনক একটা বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে।

প্রশ্ন: মধ্যপ্রাচ্যে কি বৃহত্তর পরিসরে রাশিয়ার সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? ইউক্রেনে তাদের সমস্যা থেকে মনোযোগ সরানোর চেষ্টা হিসেবে আংশিকভাবে রাশিয়া এমনটা করতে পারে?

কিসিঞ্জার: ইউক্রেন যুদ্ধের আগে রাশিয়া সাধারণত আরবদের সঙ্গে সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে ছিল। রাশিয়া যদি এখন হস্তক্ষেপ করে, তবে তার কাছে দুটি বিকল্প রয়েছে। আর তা হলো আরবদের পক্ষে যুক্ত হওয়া কিংবা সংকটে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে হাজির করা, যা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অদ্ভুত বিষয় হবে।

প্রশ্ন: বর্তমান সংকট কি তাইওয়ানে চীনের আক্রমণের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে? গত কয়েক সপ্তাহে সেখানে পরিস্থিতি খুবই শান্ত ছিল।

কিসিঞ্জার: আমার মতে, চীন এ ধরনের সংঘাতের জন্য প্রস্তুত নয়। এটি তার জন্য একটি তাত্ত্বিক সুযোগ। আমার দৃষ্টিতে চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের সক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমাদের এ ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে, আমাদের মধ্যে যে ধরনের মনোভাব গড়ে উঠেছে, তা যেন এই বিষয়কে অসম্ভব করে না তোলে।

প্রশ্ন: তাহলে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কী হওয়া উচিত?

কিসিঞ্জার: যুক্তরাষ্ট্রের উচিত চীনের সঙ্গে সবকিছু মিটমাট করা।

প্রশ্ন: নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসনের একটি বড় অর্জন ছিল মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বের করে দেওয়া। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সোভিয়েতদের বিতাড়নের জন্য আপনি যতটা না খ্যাতি অর্জন করেছেন, তার চেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। আমাদের কি এখন রাশিয়া বা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বের করে দেওয়া দরকার? এটি কি একটি ভালো ধারণা বা তা কি বর্তমান সংকটসহ অন্য ক্ষেত্রে কোনোভাবে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে পারবে?

কিসিঞ্জার: এসব শক্তিকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বের করে দেওয়ার সক্ষমতা বা তাদের ইতিবাচক ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করার বিষয়টি মূলত চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। আর এই সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে না। রাশিয়ার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, এ মুহূর্তে তাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তাদের চিন্তাভাবনা কী, তা আমরা শুনিনি। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের কোনো সংলাপ নেই।



ফেইসবুক পেইজ