বর্ষা মৌসুমেও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন মোহাম্মদপুর নতুন কাঁচা মার্কেটের (কৃষি মার্কেট) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড বলে দেয় রাজধানীর মার্কেটগুলো অগ্নিদুর্ঘটনার দিক থেকে কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় সূত্রপাত হওয়া আগুন ফায়ার সার্ভিস, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের প্রায় পাঁচ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় নিয়ন্ত্রণে এলেও ততক্ষণে আড়াই শ দোকান হয় পুড়ে যায়, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে কয়েক শ ব্যবসায়ী তাঁদের জীবিকার সম্বল হারান।
আর সব অগ্নিকাণ্ডের পরই যেমন বেরিয়ে আসে মার্কেট কর্তৃপক্ষের অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার সীমাহীন ফিরিস্তি, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটও তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রাথমিকভাবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষের ধারণা, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট কিংবা মশার কয়েল থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বাস্তবে অগ্নিকাণ্ড কিংবা অন্য যেকোনো দুর্ঘটনার অজস্র কারণ মার্কেটটিতে বিদ্যমান ছিল।
একতলা টিনের ছাউনির মার্কেটটিতে উত্তর সিটি করপোরেশন কাগজে-কলমে বরাদ্দ দেয় ৩১৭টি দোকান। কিন্তু বাস্তবে মার্কেটটিতে দোকান ছিল ৫০০-এর বেশি। এর বাইরেও দোকানমালিক ও ব্যবসায়ীরা অবৈধভাবে দোকানের সিলিংয়ের ওপর গুদাম নির্মাণ করেছিলেন, যেগুলো তাঁরা অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিতেন। মার্কেটটিতে আগুন নেভানোর কোনো উপকরণ কিংবা পানির উৎস ছিল না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ছয় মাস আগে কৃষি মার্কেটকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে।
প্রশ্ন হলো, সিটি করপোরেশনের মতো সেবা সংস্থা শুধু মার্কেট তৈরি করে আর দোকান ভাড়া দিয়েই কি তাদের সব দায়িত্ব শেষ বলে মনে করবে? দোকানি ও ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছেমতো মার্কেটের নকশা ও কাঠামোর পরিবর্তন করবেন, তা দেখভাল করবে কে? গত এপ্রিল মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মালিকানাধীন বঙ্গবাজার ও নিউমার্কেটসংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ আগুনে প্রায় ছয় হাজার দোকান পুড়ে যায়। ওই দুটি অগ্নিকাণ্ডের পরও অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার একই চিত্র বেরিয়ে এসেছিল।
২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দুই বছর ঢাকার বিপণিবিতানগুলো পরিদর্শন করে অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বিপণিবিতানের তালিকা করে ফায়ার সার্ভিস। ২০১৯ সালে প্রকাশ করা ওই তালিকায় ১ হাজার ৪৮টি বিপণিবিতানকে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪২৮টি অতিঝুঁকিপূর্ণ। এ বছরের প্রথম তিন মাসে রাজধানীর ৫৮টি বিপণিবিতান পর্যবেক্ষণ করে ফায়ার সার্ভিস। এর সবগুলো ছিল ঝুঁকিপূর্ণ।
ফায়ার সার্ভিসের এই তথ্যই বলে দেয় রাজধানীবাসী অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকির ক্ষেত্রে কতটা জরুরি অবস্থার মুখে রয়েছেন। শুধু অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি নয়; ভেঙে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে, এ রকম মার্কেটও দিব্যি চালু রয়েছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে উত্তর সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেট ১৫ বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও ব্যবসায়ীরা সেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন।
মানুষের জীবন ও সম্পদহানির জরুরি প্রশ্ন যেখানে রয়েছে, সেখানে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস কিংবা সরকারের তদারকি সংস্থা কী করছে? আর কত দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হলে, আর কত মানুষ নিঃস্ব হলে তারপর কর্তৃপক্ষ নামের কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে? ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট কিংবা ভবনের মালিকদের নোটিশ দেওয়া ছাড়া আইনগত কোনো পদক্ষেপ আমরা নিতে দেখি না। দায় ও দায়িত্বহীনতার এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে না এলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড ও দুর্ঘটনা থেকে ঢাকাবাসীর মুক্তি নেই।
কৃষি মার্কেটের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনে মনোযোগ দিতে হবে। অন্য সব ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে এবং প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে সেগুলো আগুন ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে হবে। জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস নয়।