‘এমনই হিজল-বট-তমালের নীল ছায়া
বাংলার অপরূপ রূপ…’
এটি জীবনানন্দ দাশের কবিতার দুটি লাইন। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা হিজল, বট আর তমালের কথা এভাবেই লিখে রেখে গেছেন।
জায়গাটির নাম গোবরা বাজার। নড়াইল শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার কলোড়া ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের একটি জায়গা গোবরা বাজার। বাজারের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে চিত্রা নদী। নদীর পারে রয়েছে বিশাল একটি হিজলগাছ। স্থানীয় লোকজনের বিশ্বাস, গাছটির বয়স ২০০ বছরের ওপরে।
নড়াইল শহর থেকে নড়াইল-ফুলতলা সড়ক দিয়ে দক্ষিণ দিকে এগোলে দেখা মিলবে শান্ত–স্নিগ্ধ চিত্রার। উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে চলেছে নদীটি। গোবরা বাজার এলাকায় গিয়ে বাঁক নিয়ে পূর্বমুখী হয়েছে চিত্রা। সেখান থেকে নদীর একটি শাখা কাজলা নামে পশ্চিমে বয়ে চলেছে।
চিত্রা নদীর দুই তীরজুড়ে গোবরা বাজার। বাজারের মধ্যে নদীর তীরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হিজলগাছটি। এর উচ্চতা ৫০ ফুট। কাণ্ডের প্রস্থ প্রায় ৭ ফুট।
এই হিজলগাছের মালিক মহব্বত মোল্যা (৫৪)। পাশের শ্রীফলতলা গ্রামে বাড়ি তাঁর। বাজারে একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে মহব্বতের। সেখানে চা–ও বিক্রি করেন। হিজলগাছটির গোড়ায় একটি চালা বানিয়েছেন তিনি। ওই চালার নিচে মিষ্টি বানান। পরে তা দোকানে বিক্রি করেন।
মহব্বত মোল্যা বললেন, ‘হিজলগাছটির বয়স কেউ বলে ২০০ বছর, কেউ বলে ১৫০ বছর। বাপ-দাদার কাছ থেকে এই গাছের গল্প শুনে আসছি। গাছটির আসল বয়স জানি না। তবে ২০০ বছরের কম হবে না। অনেক পুরোনো গাছ, তাই আমি এটি বিক্রি করি না। রেখে দিয়েছি।’
নিসর্গবিদ এম এ তাহের বাংলাদেশের ফুল নামে একটি বই লিখেছেন। বইটিতে তিনি হিজল সম্পর্কে লিখেছেন, হিজল মাঝারি ধরনের ডালপালা ছড়ানো একটি গাছ। এই গাছ বহুদিন বাঁচে। সাধারণত জলজ কাদাপানিতে এই গাছ জন্মায়। বীজ থেকে গাছ হয়। বাংলাদেশের সর্বত্র খাল, বিল, নদী, ডোবা, হাওর ইত্যাদি জায়গায় হিজলগাছের দেখা মেলে।
লেখক আরও বলছেন, হিজল ফুল দেখতে খুবই সুন্দর। হালকা গোলাপি রঙের ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার লম্বা পুষ্পদণ্ডের মধ্যে অসংখ্য ফুল ঝুলে থাকে। হিজল গভীর রাতে ফোটে, সকালে ঝরে যায়। এই ফুলে একধরনের মিষ্টি মাদকতাময় গন্ধ আছে।
হিজলের আদি নিবাস অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ। ‘হিজল’ শব্দটি বাংলা। এর সংস্কৃত নাম ‘নিচুল’। এ ছাড়া ‘জ্বলন্ত’, ‘নদীক্রান্ত’—এসব নামেও হিজলগাছ পরিচিত। এর ইংরেজি নাম ‘ইন্ডিয়ান ওক’; আর বৈজ্ঞানিক নাম barringtonia acutangula।
হিজল মাঝারি আকারের চিরহরিৎ গাছ। বাকল ঘন ছাই রঙের এবং পুরু। ডালপালা বিস্তার চারদিকে। হিজলগাছের প্রাণশক্তি প্রবল। বন্যার পানি কিংবা তীব্র খরাতেও টিকে থাকে। এমনকি পানির নিচে কয়েক মাস ডুবে থাকলেও হিজলগাছ বেঁচে থাকে। তাই জলাবদ্ধ এলাকা বা খাল-বিল, নদী-নালা, হাওর-বাঁওড় ও ডোবার ধারে চোখে পড়ে এই গাছ।
হিজলগাছ নরম, উজ্জ্বল, মসৃণ ও টেকসই। পানিতে নষ্ট হয় না বলে সাধারণত নৌযান নির্মাণে ব্যবহৃত হয়। আসবাব তৈরি ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় হিজলের কাঠ। হিজলগাছ পাখির আশ্রয়স্থল ও বংশবিস্তারে ভূমিকা রাখে। ওষুধ হিসেবেও হিজলের বীজ ও বাকল ব্যবহৃত হয়। এর ছাল ঠান্ডা–কাশি ও বাতরোগে উপশম দেয়।
চিত্রাপারের বাসিন্দা কানাই পোদ্দার (৬৭)। তিনি বাবা ও ঠাকুরদাদার মুখে গাছটির কথা শুনেছেন। গাছটি সম্পর্কে গোয়াইলবাড়ি গ্রামের এই কানাই পোদ্দার বলেন, ‘ছোটবেলায় হিজলগাছটি দেখতে যেমন ছিল, আজও তেমনি আছে।’ তাঁর মতে, গাছটির বয়স ২০০ বছরের বেশি হবে।
চিত্রাপারের হিজলগাছটিকে শতবর্ষী বলে উল্লেখ করলেন নড়াইল সহকারী বন সংরক্ষক অমিতা মণ্ডল। তাঁর কথা, গাছটি এলাকার পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি পাখির আশ্রয়স্থল হিসেবেও অবদান রাখছে। তাই দ্রুত পরিদর্শন করে গাছটি সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন আশ্বাসও দিলেন তিনি।