ঢাকায় বসবাস করা অনেক মানুষের একটা সময় কেটেছে গ্রামে। গ্রামীণ জীবনের অনেক স্মৃতি তাঁদের তাড়িত করে। যাঁরা ইট-পাথর ও কংক্রিটের জঞ্জালে থেকে হাঁপিয়ে ওঠেন, গ্রামীণ পরিবেশ তীব্রভাবে অনুভব করেন; তাঁরা এক বিকেলে গ্রামীণ জীবনের ছোঁয়া নিতে চলে আসতে পারেন ঢাকার বুকেই আফতাবনগরে। ঢাকার রামপুরা ব্রিজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে সোজা পূর্ব দিকে এমন গ্রামীণ আবহ।
নিরিবিলি সড়ক, সড়কের পাশে সবুজ ঘাস, গবাদিপশু, তরুলতা, গুল্ম, কাশফুল, ঘাসফুল, জঙ্গল, জলাশয় ও বাঁশের সাঁকোর অনিন্দ্য দৃশ্যপট মুহূর্তের মধ্যে আপনাকে গ্রামীণ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে বনশ্রীর পাশে মেরাদিয়া বাজার থেকে বাঁশের সাঁকো হেঁটে পার হয়ে ঢুকলাম আফতাবনগর আবাসিক এলাকায়। এটি জহুরুল ইসলাম সিটি হিসেবেও পরিচিত। সেখানে সারি সারি ব্যাটারিচালিত রিকশা। বেশির ভাগ রিকশাচালক ঘুরতে আসা লোকজনকে কাশবন মোড়ের যাত্রী করতে মুখিয়ে থাকেন। ভাড়া চেয়ে বসেন ৫০ থেকে ৬০ টাকা। দর-কষাকষি করে ৩০ টাকা ভাড়ায় কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাশবন মোড়ে। রিকশা থেকে নামতেই চোখে পড়ল বেশ কিছু ছেড়ে দেওয়া গরু পিচঢালা সড়কের পাশের জমিতে সবুজ ঘাস খাচ্ছে। পাশেই সাদা কাশবনে ছবি তুলছেন দর্শনার্থীরা।
এখানে ঘুরতে আসা আদনান নামের এক কলেজছাত্র বললেন, এলাকাটা দেখতে সুন্দর, তাই তিন বন্ধু মিলে এখানে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে এসেছেন। কাশবন মোড়ের (এন ব্লক) কাছেই একটি বদ্ধ জলাশয়। সেই জলাশয়ে নৌকার এক পাশে বসে আপনমনে বিড়ি টানছিলেন, আর ঘুরতে আসা তিন তরুণের সঙ্গে গল্প করছিলেন এক বৃদ্ধ। ওই বৃদ্ধ বললেন, নিজের জমি ও কিছু জমি বর্গা নিয়ে জলাশয়ে বিভিন্ন মাছ চাষ করেছেন। পাশাপাশি ঘুরতে আসা লোকজনকে টাকার বিনিময়ে জলাশয়ের চারপাশে ঘোরান। এতে জনপ্রতি ৫০ টাকা নেন।
কাশবন মোড় থেকে পিচঢালা সড়ক ধরে হেঁটে সোজা দক্ষিণ দিকে ফেরার পথে শীতল বাতাসের ঝাঁপটা এসে দেহ-মনকে প্রশান্তি দিয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এসে সড়ক বিভাজকের গাছের নিচে থামতে বাধ্য করল। এম ব্লকের পাশে তিন রাস্তার মোড়ে চটপটি, ঝালমুড়ি ও বুট-বাদামের কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ দোকান বসেছে। ফুচকা ও চটপটি বিক্রেতা নুরুন্নাহারের দোকানে সবুজ গালিচায় কিংবা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ৫০ টাকায় খেয়ে নিতে পারেন এক প্লেট ফুচকা কিংবা চটপটি।
নুরুন্নাহার বললেন, সারা বছরই এখানে মানুষ ঘুরতে আসে। তবে শরৎকালে কাশবন দেখতে ভিড় বাড়ে। শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মানু্ষের আনাগোনা বেশি হয়। তখন তাঁর বিক্রিও বাড়ে।
তিন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পূর্ব দিকে তাকালে চারদিকে পানি মাঝখানে গাছগাছালিতে ঘেরা টিনের ঘর চোখে পড়ে। সেটি জহিরুল ইসলাম দারুল উলুম মাদ্রাসা। দেখে মনে হয়, দ্বীপের মধ্যে মাদ্রাসাটি স্থাপিত। মাদ্রাসায় যেতে হয় বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে। সাঁকোটির সামনে ঘাস পরিষ্কার করছিলেন মাদ্রাসাটির তরুণ ছাত্র আরিফ ইসলাম। তাঁর বাড়ি হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায়। বছরখানেক আগে তিনি ঢাকার বনশ্রীর একটি মাদ্রাসায় পড়তেন। সেখানে মন বসাতে পারেননি। তাই এখানে নিরিবিলি গ্রামীণ পরিবেশে এসে তাঁর মন বসেছে। তিনি এখন মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আরিফের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একই মাদ্রাসার তরুণ শিক্ষার্থী মো. দ্বীন ইসলাম। তিনি বলেন, এখানে জলাশয়, নৌকা, মাঠ-ঘাট—গ্রামের মতো সবই আছে। ঢাকার বুকেই এমন গ্রামীণ পরিবেশ পেয়ে তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই আছেন।
আরিফ ও দ্বীন ইসলামের সঙ্গে আলাপ চলাকালেই শিশু-কিশোরদের হইহুল্লোড় কানে এল। পাশেই চোখ পড়ল, একদল শিশু-কিশোর কড়ইগাছে চড়ে ফুল পাড়ছে। দুরন্ত শৈশবে যা কাজ, তা–ই করছিল শিশু-কিশোর দল। এত সব দৃশ্য-গল্পের মুখোমুখি হয়ে আপনার মনে হবে, এই তো গ্রামেই আছেন, ভালোই আছেন।
এ যাত্রায় পরিবারের সদস্য, স্বজন, প্রিয়জন সঙ্গী থাকলে মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের ধ্বনি শোনামাত্র ফেরার প্রস্তুতি নেওয়া উত্তম। আর সমবয়সী বন্ধুরা থাকলে সন্ধ্যার আড্ডাটা এখানেই দিতে পারেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলে এখানকার নিরিবিলি সড়কে ছিনতাইয়ের আশঙ্কা সচেতন মানুষ করতেই পারেন। তাই এবার বন্ধুরা হেঁটে গল্পে গল্পে রামপুরা ব্রিজে চলে আসতে পারেন। কিংবা ব্যাটারিচালিত রিকশাপ্রতি ৫০ টাকা ভাড়ায় আবার ফিরতে হবে কংক্রিটের জঞ্জালে।