রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ন
                                           

দারিদ্র্যের কারণে মেয়েকে আত্মীয়ের কাছে দিয়ে এখন কাঁদছেন মা

স্বামী সিবন সরদার যখন মারা যান, তখন রোজিনা আক্তার তিন মাসের সন্তানসম্ভবা। সংসারে উপার্জন করার মতো আর কেউ ছিল না। অনাগত সন্তানের ভরণপোষণের কথা ভেবে জন্মের পরপরই সেই সন্তানকে নিঃসন্তান এক আত্মীয়ের কাছে তুলে দিয়েছিলেন রোজিনা। এখন সেই সন্তানকে ফিরে পেতে দিনরাত কাঁদছেন তিনি।

ঘটনাটি শরীয়তপুর সদর উপজেলার চরডোমসার গ্রামের বেঁদেপল্লির। সন্তান ও সংসারের দুশ্চিন্তায় অসুস্থ রোজিনা অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এখন তিনি তাঁর সন্তানকে ফেরত পেতে চান। কিন্তু রোজিনার সেই স্বজনেরা এখন মেয়েকে ফেরত দিতে চান না।
বেঁদেপল্লির বাসিন্দারা জানান, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার খৈরা গ্রামে বাড়ি ছিল রোজিনাদের। পদ্মার ভাঙনে বসতবাড়ি বিলীন হয়ে গেলে ২০০৩ সালে তাঁরা শরীয়তপুর সদর উপজেলার চরডোমসার এলাকার কীর্তিনাশা গ্রামে বসতি গড়েন এবং বেঁদে হিসেবে তাঁরা আদি পেশায় নিয়োজিত হন। যা আয় হতো তা দিয়ে কোনোমতে তাঁদের সংসার চলত। সেখান থেকে কিছু টাকা জমিয়ে চরডোমসার এলাকায় ৪ শতাংশ জমি কিনেছিলেন সিবন সরদার। টাকার অভাবে তাতে ঘর তুলতে পারেননি। বাঁশ ও প্লাস্টিক দিয়ে খুপরি তৈরি করে বসবাস করতেন।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে সিবন সরদার মারা যান। তখন তাঁর স্ত্রী রোজিনা তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন রোজিনা। বেঁদেপল্লির কয়েকজনের পরামর্শে রোজিনা গর্ভের সন্তান জন্মের পর এক আত্মীয়কে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল কন্যাসন্তানের জন্ম হলে পলি আক্তার নামের এক নারীর হাতে তুলে দেন। নিঃসন্তান পলি স্বামী আশরাফুলের সঙ্গে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার গোয়ালদিমান্ডা গ্রামে বসবাস করেন।
রোজিনা ও সিবন দম্পতির তিন মেয়ে ও এক ছেলে। অভাবের সংসারে সিবন বেঁচে থাকতে কিশোরী বয়সে দুই মেয়েকে বিয়ে দেন। ছেলের বয়স ১০ বছর। দারিদ্র্যের কারণে তাকে পড়ালেখা করাতে পারছেন না রোজিনা। এ অবস্থায় অভাবের সংসার ও গর্ভের সন্তান হারিয়ে দিশাহারা রোজিনা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অসুস্থ থাকায় কাজ করতে পারেন না। বেঁদেপল্লির বাসিন্দা হওয়ায় অন্য কেউ কাজেও নেন না। সন্তানকে ফিরে পেতে কেঁদে কেঁদে চোখ ভাসাচ্ছেন রোজিনা।

রোজিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে মুন্সিগঞ্জ ছেড়েছি। ২০ বছর ধরে শরীয়তপুরে থাকছি। এখানকার ভোটার হয়েছি। কখনো সরকারি কোনো সহায়তা পাইনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। মুখে খাবার তুলে দিতে পারব না, ভেবে গর্ভের সন্তান অন্যের কোলে তুলে দিয়েছি। কোন পরিস্থিতিতে পড়লে কোনো মা সন্তানকে অন্যের হাতে তুলে দেন? মেয়েটির জন্য দিনরাত কাঁদছি। এখন তাকে ফিরে পেতে চাই।
তবে রোজিনার আত্মীয় পলি আক্তার এখন ওই সন্তানকে আর ফেরত দিতে চান না। পলি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোজিনা আমাদের আত্মীয়। তাঁর স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানের চিকিৎসা, খাওয়াদাওয়ার খরচ জোগাতে পারছিলেন না। তখন শিশুকন্যাকে লালন-পালনের জন্য আমাদের দিয়ে দেন। আমি শিশুটির মা না হলেও মায়ের স্নেহে আগলে রাখছি। আমরা তার মায়া-মমতায় জড়িয়ে পড়েছি। এখন তাকে ফেরত দিতে চাই না।’

বেঁদেপল্লির সরদার আসকান মিয়া বলেন, তাঁরা দেড় শতাধিক মানুষ বেঁদেপল্লিতে থাকেন। তাঁদের অনেকে অসহায়। রোজিনার অবস্থা খুবই খারাপ। চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও তাঁর খোঁজ নেননি। বছরখানেক আগে শিশুসন্তানকে এক আত্মীয়ের কাছে দিয়ে এখন কাঁদছেন। তাঁকে ফেরত চাইছেন। কিন্তু তাঁরা কিছুই করতে পারছেন না। ডোমসার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, বেঁদেপল্লির অনেককে বিভিন্ন সময় সহায়তা করা হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সহায়তার আওতায় আছেন অনেকে। তবে রোজিনার অসহায় অবস্থার কথা জানা ছিল না।

রোজিনার দুর্দশার কথা শুনে সম্প্রতি জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ ও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র চরডোমসার বেঁদেপল্লিতে যান। জেলা প্রশাসক ১০ হাজার টাকা ও খাদ্যসহায়তা দেন এবং একটি ঘর তৈরি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

ইউএনও জ্যোতি বিকাশ চন্দ্র প্রথম আলোকে বলেন, বেঁদেপল্লির বাসিন্দা রোজিনা খুবই অসহায় অবস্থায় আছেন। তাঁর কথা জানতে পেরে জেলা প্রশাসক সেখানে যান এবং তাঁকে কিছু সহায়তা করেন। তাঁকে একটি ঘর করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং বিধবা ভাতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁর শিশুসন্তানকে ফিরিয়ে আনতে চাইলে সহায়তা করা হবে।



ফেইসবুক পেইজ